উপরে বর্ণিত পাকা কবরের স্থান থেকে আনুমানিক ৪০ গজ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পাকা রাসত্মার পশ্চিম ধারে সামান্য টিলা সদৃশ একটি জায়গা আছে। এর পশ্চিম ধারে ঢালু স্থানে পাশাপাশি দুটি সমাধি রয়েছে। সমাধি দুটির দক্ষিণ ধারে পরিখা বা ছোট পুকুরের মতো গর্তবিশেষ দেখা যায়। যাহোক, পাকিস্থানের আমলের প্রথম দিকে স্থানটি জঙ্গলে ঢাকা ছিল। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা জঙ্গল পরিস্কারকালে এই সমাধি দুটি দৃষ্টিগোচর হয়। দক্ষিণ দিকের সমাধিটি শাহ ইসমাইল গাজীর বলে মাজারের খাদেমসূত্রে জানা যায়। দৈর্ঘ্য ৮ ফুট ও প্রস্থ ৫ ফুট। সমাধি দুটি ইটের প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। এরূপ জনশ্রম্নতি আছে বহু দিন যাবত মাজারটি জঙ্গলে ঢাকা ছিল। এই জঙ্গলের ভিতর মাজারের পাশে দিন রাত একটি বাঘ পাহারা দিতো। এ বাঘ কারো ক্ষতি করতো না। স্থানীয় লোকেরা মানতি দ্রব্যাদি নিয়ে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে এলে বাঘটি দূরে সরে যেতো। আরো জানা যায়, এ মাজারের অসম্মান হলে বড় ধরণের ক্ষতি বা দুর্ঘটনা ঘটতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মি.এস,কে ঘোষ কোন রকম সম্মান দেখানো ছাড়াই মাজারের পাশ দিয়ে মোটর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলে তিনি দুর্ঘটনায় পড়েন। তবে তিনি জীবনে বেঁচে গেছেন। মাজারকে অসম্মান করা হয়েছে এটা তিনি বুঝতে পেরে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ নিজ অর্থে মাজারটি পাকা করে দেন। ১৯৯৫ সাল পর্যমত্ম মি. ঘোষের বাঁধানো স্থাপত্য কাঠামোটি অটুট ছিল। তার পরে একধিকবার সংস্কার করা হয। বর্তমানে সেখানে একজন নিয়মিত খাদেম আছেন যিনি মাজারের খেদমত করে থাকেন। উক্ত মাজারে এখনো জিয়ারত ও সম্মান দেখানো হয়। অতি সম্প্রতি সেখানে একটি সুরম্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
রিশালাতুস সুহাদা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই ইসমাইল গাজী গৌড়ের সুলতান রম্নকনউদ্দিন বরবক শাহ এর (১৪৫৯-১৪৭৬ খ্রিঃ) প্রধান সেনাপতি ছিলেন। পার্শ্ববর্তী কামরূপ রাজ্যের অত্যাচার দমনের উদ্দেশ্যে গৌড় থেকে শাহ ইসমাইল গাজী কিছু সৈন্য সমামত্মসহ ঘোড়াঘাট এলাকায় আসেন। পথে দিনাজপুরের (বর্তমান নওগাঁ) সমেত্মাষ নামক স্থানে কাসেত্মশ্বর/কামেশ্বর রাজার সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে মাত্র ১২ জন পাইকসহ ঘোড়াঘাটের বারপাইকের গড়ে আশ্রয় গ্রহন করেন এবং ধ্যান মগ্ন হন । উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন । এর কিছু দিন পরে সুযোগ এসে গেল । উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হলো । এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে রাজা যুদ্ধ না করে গৌড়ের সুলতানের বশ্যতা মেনে নেন । এতে গাজীর বিজয় সূচিত হয় । কিন্তু ঘোড়াঘাট দুর্গের অধিনায়ক ভান্দুসী রায়ের চক্রামেত্মর কারনে সুলতানের নির্দেশে গাজীর শিরোচ্ছেদ করা হয় (১৪৭৪ খ্রি .) কাটাঁদুয়ারে । গাজীর ধড়ের একটি অংশ সমাধিস্থ করা হয় ঘোড়াঘাটে । আলোচ্য সমাধিটি সেই সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজীর । আগের চেয়ে মাজার ও তৎসংলগ্ন স্থানের বেশ উন্নতি হয়েছে এখন
ঘোড়াঘাট থানা ভবন থেকে ২ কিলোমিটার উত্তর দিকে শহরগাছী মৌজা। মৌজার মোট জমি ১৭৩ একর। ১৯৭৪ সালে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪৫ জন। সেখানে বেশ কয়েক ঘর আদিবাসী সাঁওতালের বসত আছে। থানা ভবনের পাশ দিয়ে একটি সরম্ন পাকা রাসত্মা এঁকেবেঁকে চলে গেছে উত্তরে দিকে । ঝোপঝাড় পার হয়ে একটু উত্তরে গেলেই ঘোড়াঘাটের বিখ্যাত পীর ও কাজী সদরম্নদ্দিন সাহেবের মাজার এলাকা। প্রথমেই দেখা যাবে কাজী সদরম্নদ্দিনের (রহঃ) এর ১২ দুয়ারী প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। তার উত্তরে আছে (৩৫ গজ দুরে) সমাধিস্থ এবং সমাধির উত্তর ধারে আছে মোঘল আমলে নির্মিত সৌন্দর্যমন্ডিত একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। এই স্থানের উত্তর-পূর্ব দিকে আনুমানিক ১০০ গজ দূর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে করতোয়া নদী। কাজী সাহেবের বাসভবনের পূর্ব পাশে দু-এক ঘর সাঁওতালের বসত আছে। তারা অনেক দিন ধরে এখানে বাস করছেন। বলতে গেলে অনেকটা জনমানবহীন এই স্থানে একা এলে গা শিউরে উঠবে। অথচ এক সময় এই স্থান ছিল কোট- কাচারীর মতো সরগরম।
(ক) ১২ দুয়ারী প্রসাদঃ বারদুয়ারী বাস স্থান থেকে ৩০ গজ উত্তর দিকে কাজী সাহেবের মাজার। সামনের দিকে প্রবেশ পথ, তাতে আছে কাঁটাতারের বেড়া, কোথাও কোথাও অনুচ্চ প্রাচীর আছে। জনমানবহীন জায়গা। এখানে এক এলে ভয় লাগে। অনেক গুলো লম্বা লম্বা সমাধি মাজারের পূর্বধারে রয়েছে। সমাধিগুলো কার সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এই মাজারে একজন বয়োবৃদ্ধ খাদেম আছেন। তিনি জানান, এই কবরগুলো মাজারের খাদেমদের। দীর্ঘ দিন মাজারের খেদমত করে যে যখন মারা গেছেন তখন তার সমাধি এখানেই দেয়া হয়েছে।
দেওয়ান গাজীর মাজার
সিংড়া ইউনিয়নের অমত্মর্গত বিরাহিমপুর কাচারীর ৫০ গজ পূর্ব- উত্তর দিকে এবং বার পাইকেরগড়ের পশ্চিমে মইলা নদীর তীরে বটগাছের নিচে একজন গরীবের মাজার আছে। এটি দেওয়ান গাজীর মাজার বলে খ্যাত। আগে এখানে প্রাচীন ইটের স্ত্তপ ছিল। পাকিসত্মান আমলে এই স্ত্তপ পরিস্কার কালে এখানে একটি মাজারের অসিত্মত্ব আবিস্কার হয়। শাহ ইসমাইল গাজীর কোন অনুচরের মাজার হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। কারণ ইসমাইল গাজী ১২ জন পাইক সমেত এখানকার পার্শ্ববতী গড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদেরই একজনের মাজার বলে অনুমিত। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকের কাছেই এ মাজার একটি পূন্যভূমি। একই ইউনিয়নের রাণীগঞ্জ বাজারের পশ্চিম ধারে একজন পীর সাহেবের সমাধি আছে। তার নাম পীর সাহেব আব্দুল কাদের।
পাঁচ পীরের দরগাহ
উপজেলার পালশা ইউনিয়নের অমত্মর্গত প্রাচীন দীঘিপুকুর ও আদিবাসী সমৃদ্ধ গ্রাম বেলোয়া। এখানকার ছয়ঘাটি দীঘির উত্তর ধারে দুই বিঘার মতো উচু একটি স্থানে পাঁচটি সমাধির মতো স্থান পরিলক্ষিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এটি পাঁচ পীরের দরগা বা মাজার। মেজর শের ইউলর মানচিত্রে স্থানটি ‘‘ পানি পীর সাহেবি পুকুর’’ নামে উলেস্নখ করা হয়েছে। মুলত এটি পাঁচ পীরের পুকুর। এখানকার ভাতছালা গ্রামের বশির সরকার এখান থেকে পিতলের একটি আসা পান বলে বাংলাদেশ প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে উলেস্নখ আছে। উক্ত আসার মাথা তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। মধ্যভাগে বাঘের মাথার ছবি এবং অন্য দুই ভাগে মাছের প্রতিকৃতি অংকিত ছিল। মধ্যভাগে কালেমা তৈয়বা, মোহাম্মাদ মোসত্মফা (সঃ) এর পাক আমলের শেষের দিকে দিনাজপুরের ডিসি মহোদয় সংগ্রহ করে দিনাজপুর মিউজিয়ামের সংরক্ষণের জন্য জমা দেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেখান থেকে আসাটি হারিয়ে যায়।
মাওলানা নুর উদ্দিন (রহ)’র মাজার
ঘোড়াঘাট- কামদিয়া রাসত্মার পাশে সাবেক মহুয়ার বাগ নামক স্থানে পাকা রাসত্মার পাশে মাজারটি অবস্থিত। মাজার কেন্দ্রিক সাবেক স্থাপনা অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কালে কটাক্ষ উপেক্ষা করে কেবল মাজারটি টিকে আছে। এমন কি মাজারের ঘর টিও নষ্ট হয়ে গেছে। জানা যায় মওলানা নূরউদ্দিন ঘোড়াঘাটে সম্রামত্ম মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শিখে ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা বিসত্মারে মনোযোগী হন। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, সাধক শাস্ত্রজ্ঞ আলেম ও ইসলাম প্রচারক ছিলেন। আরো জানা যায়, তিনি অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। তার ওয়াজ শোনার জন্য সভাস্থলে দলে দলে লোকজন আগমন করতো। তার মৃত্যর পরে এখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তার কাম্যত সর্ম্পকে এখনো অনেকে কথা শোনা যায়। আপদ বিপদে আত্বানা লাভ ও রম্নহানা ফায়েজ হাসিলের উদ্দ্যেশ্যে অনেক লোক মাজার জিয়ারত আগমন করেন।
খন্দকার বদরে আরেফিন (রহঃ) র মাজার
ঘোড়াঘাট বাজারের কেন্দ্রস্থল থা্না ভবনের পূর্ব দিকে মসজিদের পাশে মাজারটি অবস্থিত। তিনি ঘোড়াঘাটেই জন্ম গ্রহন করেন। এখানেই শিক্ষা লাভ করেন বলে জানা যায়। তার পিতৃ পরিচয় জানা না গেলেও তিনি একজন নামকরা আলেম, পীর, উন্নত ব্যক্তিতব সম্পন্ন মানুষ, নীতিবান, শিক্ষানুরাগী রম্নপে সমাজে পরিচিতি ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তার নিজস্ব বাসভবনে আশে পাশে সে সময় গড়ে উঠেছিল মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ। তার ওফাত লাভের পরে এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। সমাধিটি ৭ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট প্রস্থ। সমাধির পশ্চিম পাশেই কয়েক খন্ড কালো পাথর পড়ে আছে। এখনো তার মাজারে প্রতিদিন জিয়ারত হয়। মাজারের পাশেই রয়েছে আধুনিক সুরম্য একটি মসজিদ। তাকে স্মরনীয় করে রাখার লক্ষ্যেই ‘বদরে আরেফিন, নামে ঘোড়াঘাট একটি ফিলিং স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে।
দেওয়ান পীরের মাজার
উপজেলার পশ্চিম দিকে পালশা ইউনিয়নের অমর্ত্মগত ডুগডুগী মোকাম নামক বাজারে দেওয়ান পীর সাহেবের মাজার অবস্থিত। এ মাজারে সমাহিত ব্যক্তির আগমন সর্ম্পকে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা এ মাজারকে যথেষ্ট মান্য করেন। প্রকৃত নাম অজ্ঞাত। সাধারনের মাঝে দেওয়ান পীর বলেই পরিচিত।
শাহ দরিয়া বোখারী (রহ.)র মাজার
ঘোড়াঘাট করতোয়া নদীর ত্রিমোহনী ঘাটের পশ্চিম ধারে চৌখন্ডি মৌজার প্রাচীযন ঈদগাহ মাঠের অভ্যমত্মরে প্রায় ৩০ টির মতো সমাধি আছে। সমাধিগুলোর একটি শাহ দরিয়া বোখারীর মাজার। ঘোড়াঘাট চারমাথা বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে পাকা রাসত্মার শেষ প্রামেত্ম গিয়ে উত্তর দিকে তাকালে বাঁশঝাড়ের কিনারে প্রাচীন ঈদগাহ মাঠের অবস্থান। ঈদগাহ মাঠের চর্তুপাশ পাকা প্রাচীর আছে। দক্ষিণ দিকে আছে প্রধান ফটক। তাতে লেখা আছে দরিয়া বোখারী (রহ,) র মাজার। দরিয়া বোখারীর প্রকৃত পরিচয় জানা যায় না। তিনি শাহ সুজার আমলে প্রথম দিকে বোখারা থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আগমণ করেন বলে জনশ্রম্নতি আছে। তিনি এখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ মাদ্রাসায় তিন শতাধিক ছাত্রের আবাসিক সুবিধা ছিল। মধ্যযুগের ঘোড়াঘাট সরকার এর বিখ্যাত সাধক কবি হেয়াত মামুদের ১৭৫৮ সালে রচিত ‘আম্বিয়া বাণী’ পুঁথিতে শাহ দরিয়া বোখারী (রহ) এর বন্দনার উলেস্নখ পাওয়া যায়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস